সূর্যাস্তের দশ বছর

  • 19 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 126 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
১৮ মে ২০১৫ থেকে ১৯ মে, ২০২৫… দশ বছর পেরিয়ে গেল অরুণার সূর্যাস্তের। ভোট এল গেল, আইন বদলালো। নির্ভয়া, সুজেট, সন্দেশখালি বা কামদুনির হতভাগ্যরা এবং হালফিলের অভয়া কাণ্ড… অরুণারা প্রতিবার নব রূপে নব নামে ফিরে ফিরে এল। চলেও গেল। আমাদের স্মৃতিপটে লেখা গনগনে প্রশ্নটা কিন্তু এখনও অস্ত যায় নি – ‘আর কবে?’ ‘আর কতদিন? কতবার?

"কোরা কাগজ থা দিল ইয়ে মেরা / লিখ দিয়া নাম উসমে তেরা..."
আজ তার বিয়ে।
মেয়েদের বিয়ের ঠিক হলে কেমন একটা ভাব আসে তাদের। খানিক দুশ্চিন্তা, খানিক চাপা আনন্দ, কিছুটা ভয় আর আলো আঁধারিমাখা কিছু স্বপ্ন। লোকে বলে প্রি-ম্যারিটাল সিন্ড্রোম! সে কিন্তু বুঝতে পারছে এতদিনের চাওয়া পাওয়ার সঠিক আদলটা কেমন!
স্কুল কলেজ জীবনের পর মেয়ের যে অনিশ্চিত জীবনটা নিয়ে বাবা মায়ের রাতের ঘুম উড়ে যায়, তার একটা হিল্লে হয় যেন।

বাড়িটা দুদিন হল চেহারা ফিরে পেয়েছে। ছোটরা সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকছে, বাড়ি জুড়ে হাহা -হিহি, বড়রা নানাদিক থেকে উপদেশ দিচ্ছে। যেন আগামীকাল তার এতদিনের চেনা জীবন চুটকিতে বদলে যাবে। সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না আদৌ এই বদল নিয়ে সে আনন্দিত কিনা! শুধু এটুকু বুঝছে যে প্রতি সকালে ঘুম ভাঙলে যে বিছানার ওম ছাড়তে তার গড়িমসি হত, সেই বিছানায় কাল থেকে তার গন্ধটা থাকবে না। তার সেই পড়ার টেবিলেও থাকবে না প্রতিদিনের কাগজটা।


মহাকালের ধূলোয় ঢেকে যাবে তার নোটবই, গানের খাতা, নার্সিং বইগুলো, গোপন ডায়রিটা... এগুলোর দিকে সে তাকাতে চাইছে না, তবু যতবার চোখ পড়ছে ভেতরটা ডুকরে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। আর ঠিক তখনই যেন কেউ ভেতর থেকে বলে উঠছে, "ভয় পাচ্ছ কেন, সে আছে তো! সে তোমায় সব দেবে। নতুন বিছানা, নতুন পড়ার টেবিল, নতুন বই - সব ধীরে ধীরে পুরনো হবে তোমার গন্ধ। ভয় পেও না, সে আসছে তোমার নতুন জিয়নকাঠি নিয়ে। "
অনাগত যুবককে সে ভরসা করতে চাইছে, এই মন ভালো করা অন্য স্বরকে সে বড্ড বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তার আর ভয় করছে না।
আচ্ছা, বিয়ের দিন কি সবার এমন লাগে ?


তারিখ ২৭ নভেম্বর,১৯৭৩।
অরুণার জীবনের নতুন অরুণ আগত প্রায়। প্রিয় পুরুষের ভালবাসার বার্তা নিয়ে যেন আজকের সূর্যোদয় ঘটবে। 
আজ ডিউটিতে সে লাড্ডু খাইয়েছে কলিগ ও বাকি স্টাফদের। হাতের মেহেন্দির রং গাঢ় লাল হয় কী করে তারা চুপিচুপি বলে দিয়েছে। হাসাহাসি, ফিসফাস মিলে ওয়ার্ডে খুশির পরিবেশ।  সময়ের কাঁটা যত গড়াচ্ছে, তত সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। আজকের ডিউটি শেষ হলেই বেশকিছু দিনের ছুটি পাওয়া যাবে।

এইসব ভাবতে ভাবতে নির্জন করিডোর পার হচ্ছিল অরুণা। চিন্তার সুতোটা আচমকা ছিঁড়ে গেল পেছন থেকে দুটো শক্ত হাতের বাঁধনে। আঁতকে উঠে ঘুরেই দেখল দুটো কুতকুতে চোখে হায়নার দৃষ্টি নিয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে সোহনলাল বাল্মীকি। সবার চেনা ওয়ার্ডবয়। হাতে শক্ত করে ধরা কুকুর বাঁধার চেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল সোহন লাল। এর পরে চলল নারকীয় অত্যাচার । কুকুর বাঁধার চেইনটা দিয়ে বেঁধে ফেলে শরীরের উপর চলল তাণ্ডব। লোহার মত শক্ত হাতে পিষ্ঠ হতে হতে অরুণা জ্ঞান হারাচ্ছিল। শরীরের তাল তাল মাংসগুলোর চেয়ে বড় শত্রু তখন তার আর কাউকে মনে হচ্ছিল না। সে ওই সময় খুব চাইছিল তার ভেতরের সেই অন্যস্বরটা আজ কিছু বলুক। অভয় দিক।

কিন্তু একি! নিচেটা ভিজে যাচ্ছে রক্ত, স্বেদ আর বীর্যে। জীবনে রক্ত সে অনেক দেখেছে, কিন্তু আজ তার চোখে শুধু অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে কেন! রক্তের চেয়েও তো মেহেন্দির রং গাঢ় হয়, তাই না! তাহলে তার এত অন্ধকার লাগছে কেন! চেন’টা আরো জোরে টুটিতে চেপে বসল। পাষণ্ডটা যেন নতুন শক্তিতে নিজেকে আরো গেঁথে দিল তার শরীরে, এবার বুঝি নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে...

এরপর আর কিছু মনে নেই তার।
কতক্ষণ ওইভাবে পড়েছিল সে জানে না। ডাক্তার যখন দেখলেন তখন আর কিছু করার ছিল না।
মস্তিষ্কে দীর্ঘক্ষণ অক্সিজেন না যাওয়ায় কোমায় চলে গেল অরুণা। 
কেবলমাত্র সহকর্মীদের দায়িত্বে ও পরিচর্যায় শুরু হল এক নতুন লড়াই ।

অসম যুদ্ধ। কেই বা জানত যুদ্ধটা চার যুগ ধরে চলবে! হাসপাতাল এবং আদালতে।
দীর্ঘ ১৯-২০ বছরের কোমায় তাঁর অসহনীয় অবস্থা দেখে 'স্বেচ্ছা মৃত্যু'র আবেদনও জানান সাংবাদিক পিনাকী ভিরানি। কিন্তু আইনী ঝামেলায় তা বাতিল হয়। ভারতের ইতিহাসে এই কেসটি ছিল প্রথম 'স্বেচ্ছা মৃত্যু'র আন্দোলন।
দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পরে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট ভিরানীর আবেদনে সাড়া দেয় - প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুতে সায় দেয় শীর্ষ আদালত।

দোষী সোহন লাল কিন্তু মাত্র ১৪ বছরের জেল হাজত বাসের শাস্তি পায়। আশ্চর্যজনকভাবে তা কিন্তু এই নারকীয় ধর্ষণের জন্য নয়। অন্য একটি কেসে ডাকাতি ও হেনস্তার জন্য! অরুণা  কোমায় থাকাকালীনই ধর্ষকটির জেল যাত্রা ও জেল থেকে বেরিয়ে আসা। 
অরুণা ততদিনে প্রৌঢ়ত্ব শেষের দিকে। কতগুলো জন্মদিন পেরোল তার আর হিসেব মিলল না। এল ২০১৫, মে মাস। 
৪২ বছরের আসুরিক যুদ্ধটা এক ভোরে অবশেষে শেষ হল।

সাল ১৯৭৩, পালটে দিয়েছিল মুম্বাইয়ের নার্সিং স্টাফ অরুণা শানবাগ -এর জীবন।
সেই থেকে ২০১৫ অবধি এক বেডে, এক অবস্থায় জীবন্ত লাশ হয়ে পড়ে ছিলেন তিনি ।
এক সময় নিভে গেল তার জীবনের অরুণ। ১৮ ই মে ২০১৫।

ভারতের স্বাস্থ্য ইতিহাসে অরুণাই দীর্ঘতম সময় ধরে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা, চার দশকেরও বেশি সময় কোমায় থাকা রোগী।

সোহন লাল নিশ্চয় এতদিনে থিতু হয়েছে, ঘর সংসারে ব্যস্ত হয়েছে। ১৪ বছর তো রামেরও বনবাস হয়েছিল। তারও নাহয় তাই হয়েছে। এ আর এমন কি!

ভাগ্যিস সে পুরুষ। ভাগ্যিস তার জানা হয় নি, অরুণা শানবাগের যৌনাঙ্গের রক্ত থেকেও বেশি ঘন ছিল তার হাতের মেহেন্দি, তার হৃদয়ের লালাভ স্বপ্নেরা।
আর তার চেয়েও ঘন রং ছিল ২০১৫-র সেই বিকেলের... অরুণার জীবনের অন্তিম সূর্যাস্ত।

অরুণাও কি দেখতে পেয়েছিল সেই রক্তিমা?

১৮ মে ২০১৫ থেকে ১৯ মে, ২০২৫… দশ বছর পেরিয়ে গেল অরুণার সূর্যাস্তের। ভোট এল গেল, আইন বদলালো। নির্ভয়া, সুজেট, সন্দেশখালি বা কামদুনির হতভাগ্যরা এবং হালফিলের অভয়া কাণ্ড… অরুণারা প্রতিবার নব রূপে নব নামে ফিরে ফিরে এল। চলেও গেল।

আমাদের স্মৃতিপটে লেখা গনগনে প্রশ্নটা কিন্তু এখনও অস্ত যায় নি – ‘আর কবে?’ ‘আর কতদিন? কতবার?’

যতদিন আইনের ফাঁক থাকবে, ধর্ষক থাকবে, নারী নির্যাতন থাকবে, আমাদের প্রশ্নমালাও থাকবে।

লেখক : শিক্ষক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment